চট্টগ্রামের একটি নামকরা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকার রুমের সামনে ৫ জন শিক্ষার্থীদের একটি দল দরখাস্ত হাতে দাঁড়িয়ে আছে। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা এই ম্যাডামকে খুব ভয় পায়। যেখানে ম্যাডামের রুমের সামনে দিয়ে হাটা তো দূরের কথা সেদিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস করে না কেউ, সেখানে দল বেঁধে তার কাছে দরখাস্ত দেওয়া! সবার চোখে প্রশ্ন, কী হয়েছে?
বালিকা বিদ্যালয়টির দুই শিফট; সকালের শিফট সকাল ০৭:৩০ থেকে ১১:৪৫ পর্যন্ত এবং দুপুরের শিফট ১২:০০ থেকে বিকাল ০৫:০০ পর্যন্ত। শহরের সেরা বালিকা বিদ্যালয় হওয়ায় গোটা জেলার প্রভাবশালীও ধনী পরিবারের মেয়েরা এখানে পড়তে আসে। সকালের শিফটছুটি হলে মেয়েদের নিতে এবং দুপুরের শিফটের মেয়েদের দিতে অনেক প্রাইভেট কারএসে গেটের সামনে ভিড় করে। সমস্যা হল, প্রায়ই পার্কিংকরা প্রাইভেট কারের ড্রাইভারেরা একত্রিত হয়ে এক স্থানে দাড়িয়ে আড্ডা দেয় এবং হেঁটে যাওয়া কিংবা অপেক্ষারত শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানি করে। নানা রকম অশ্লীল মন্তব্য, অঙ্গভঙ্গী, মোবাইলে রিংটোন বাজানো, গান গাওয়া এবং ইচ্ছা করে গায়ে ধাক্কা লাগানো যেন অনেকটা দৈনন্দিন ব্যাপার। তার ওপর স্কুলের সামনের বাগানে অনেক অবাঞ্ছিত লোকের আনাগোনা দেখা যায়। এমনকি শহীদ মিনারের সিঁড়িতে বসে পার্শ্ববর্তী দুটি বয়েজ স্কুলের ইউনিফর্ম পরিহিত ছেলেরা আড্ডা দেয় ও মেয়েদের বিরক্ত করে।অনেক দিন ধরে চলছিল এমন অবস্থা।
অন্য কোন স্কুল হলে হয়ত বিষয়টি কেউ গুরুত্বের সাথে নিত না; ভাবত মেয়েদের স্কুলের সামনে জটলা হবে এ আর নতুন কি! কিন্তু এই স্কুলটি ব্র্যাকের “মেয়েদের জন্য নিরাপদ নাগরিকত্ব” (মেজনিন) কর্মসূচীর আওতাভুক্ত হওয়ায় ঘটনা সম্পূর্ণ ভিন্ন মোড় নেয়। মেজনিন কর্মসূচীর আওতাভুক্ত প্রতিটি স্কুলে প্রতিটি ক্লাসের (ষষ্ঠ – দশম শ্রেণী) প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত হয় এই স্টুডেন্ট ওয়াচ গ্রুপ যারা তাদের বিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কাজ করবে। চুপচাপ সহ্য না করে শিক্ষার্থীরা স্টুডেন্ট ওয়াচ গ্রুপের কাছে অভিযোগ করে। তারা বিষয়টি কয়েকদিন পর্যবেক্ষণ করে সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নেয় দেয়ালে লেখাপুলিশের কন্ট্রোল রুমের নাম্বার বা ১০৯২১ এ জানানোর আগে প্রধান শিক্ষিকাকে ব্যাপারটি জানাতে হবে। মেজনিন কর্মশালায় তারা শিখেছেযেকোন সমস্যায় মন খুলে বড় আপার সাথে কথা বলতে। অবশেষে স্টুডেন্ট ওয়াচ গ্রুপ এর সিনিয়র ৫ জনের একটি দল একটি দরখাস্তে ঘটনার
বিবরণ লিখে প্রধান শিক্ষিকা ম্যাডামের কাছে জমা দেয়। তিনিবিষয়টি তাৎক্ষনিক ভাবে মেজনিন কর্মসূচীর উদ্যোগে কমিউনিটির গন্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত কমিউনিটি ওয়াচ গ্রুপকে অবহিত করেন। ঐসময় বিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি নির্মূলকরণের লক্ষ্যে গঠিত চট্টগ্রাম জেলা নেটওয়ার্ককমিটির মাসিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভায় কমিউনিটি ওয়াচ গ্রুপও অংশগ্রহণ করে এবংবিষয়টি জেলা প্রশাসক মহোদয়কে অবহিত করে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়।
অবশেষে সকলের সম্মতিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে–
১. যেসব অভিভাবক ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের পৌছে দেন এবং বাড়িতে ফেরত নিয়ে যান তাদেরপ্রত্যেকের বাড়িতে নোটিশ পাঠানো হবে যাতে স্কুল ছুটির সময় কোন গাড়ি স্কুলের সামনেঅবস্থান করতে না পারে এবং অভিভাবকেরা ড্রাইভারদের এসব কাজের বিষয়েসচেতন হতে পারেন।
২. বিদ্যালয়ের সামনে স্থায়ী পুলিশ চৌকি স্থাপনের জন্য পুলিশসুপার বরাবর চিঠি প্রেরণ করা হবে।
৩. পার্শ্ববর্তী দুটি স্কুলেরপ্রধান শিক্ষক বরাবর চিঠি প্রেরণ করা হবে যাতে তাদের স্কুলের কোন ছেলে মেয়েদের স্কুলের সামনের বাগান ও শহীদ বেদীতে আড্ডাদিলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
৪. স্থানীয় জনগণ ও দোকানদারেদের সাথেবিষয়টি নিয়ে কমিউনিটি ওয়াচ গ্রুপ কথা বলবে এবং এসব সিদ্ধান্ত আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই বাস্তবায়ন করতে হবে।
মাত্র চার দিন পর সেই স্কুলে গিয়ে দেখি স্কুল গেটের সামনে কোন প্রাইভেট কার ও রিক্সা নেই, রাস্তা একদম ফাঁকা। প্রায় ১০০ মিটার দূরের মোড় থেকেই রিক্সা ও প্রাইভেট কারশিক্ষার্থীদের নামিয়ে দিয়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। বিদ্যালয়ের সামনের বাগানের পাশেচেয়ার টেবিল পেতে একদল পুলিশ বসে আছে। আর দুইজন পুলিশ গেটে ও দুইজন মোড়ে দাঁড়িয়ে দায়িত্ব পালন করছে। দেখে মনে হল, আমরা একটু সাহস করে এগিয়ে এলেই মেয়েদের জন্য এই সমাজকে অনেকটা নিরাপদ করে গড়ে তুলতে পারি।
লিখাটি পাঠিয়েছেন দেবাশীষ হালদার। তিনি সেক্টর স্পেশালিস্ট হিসেবে মেজনিন, জেন্ডার জাস্টিস এন্ড ডাইভার্সিটি প্রোগ্রামে কাজ করছেন।